ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ডিজিটাল মার্কেটস অ্যাক্ট (ডিএমএ) লঙ্ঘনের অভিযোগে অ্যাপল ও মেটাকে মোটা অঙ্কের জরিমানা করেছে ইউরোপীয় প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বুধবার অ্যাপলকে ৫০০ মিলিয়ন ইউরো (৫৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) এবং মেটাকে ২০০ মিলিয়ন ইউরো জরিমানা করা হয়। ডিএমএ আইন অনুযায়ী এটাই প্রথম শাস্তিমূলক পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক আরও খারাপ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ ট্রাম্প এর আগে মার্কিন কোম্পানিগুলোকে শাস্তি দেওয়া দেশগুলোর ওপর শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছিলেন। ট্রাম্প প্রশাসন ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই পদক্ষেপকে 'অর্থনৈতিক চাঁদাবাজির নতুন রূপ' হিসেবে আখ্যায়িত করেছে এবং বলেছে, মার্কিন সরকার এটি মেনে নেবে না। ২০২৩ সালে চালু হওয়া ডিএমএ আইনের লক্ষ্য হলো বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতা কমিয়ে ছোট কোম্পানিগুলোর জন্য বাজারে প্রবেশ সহজ করা। ইউরোপীয় কমিশনের দীর্ঘ তদন্তের পর এই জরিমানাগুলো করা হয়েছে, যা প্রমাণ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইন প্রয়োগে কঠোর। অ্যাপল জানিয়েছে, তারা এই জরিমানার বিরুদ্ধে আপিল করবে। অ্যাপলের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'আজকের ঘোষণা ইউরোপীয় কমিশনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের আরেকটি উদাহরণ। তারা একের পর এক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমাদের লক্ষ্যবস্তু করছে। এই সিদ্ধান্তগুলো ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর, আমাদের পণ্যের মান কমিয়ে দেয় এবং আমাদের প্রযুক্তি বিনামূল্যে অন্যদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য করে।' মেটাও ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছে। মেটার গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স প্রধান জোয়েল কেপলান এক ইমেইল বিবৃতিতে বলেন, 'ইউরোপীয় কমিশন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সফল মার্কিন কোম্পানিগুলোর অগ্রগতি বন্ধ করতে চাইছে, যেখানে চীনা ও ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোকে ভিন্ন মানদণ্ডে বিচার করা হচ্ছে।' তিনি আরও বলেন, 'বিষয়টি শুধু জরিমানার নয়, কমিশন আমাদের ব্যবসায়িক মডেল পরিবর্তন করতে বাধ্য করছে, যা মেটার ওপর বহু বিলিয়ন ডলারের শুল্ক আরোপের সমান এবং এর ফলে আমাদের একটি নিম্নমানের সেবা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে।' তবে, এই জরিমানার পরিমাণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের আগের প্রতিযোগিতা কমিশনার মার্গারেট ভেস্টাগার-এর আমলে দেওয়া জরিমানার চেয়ে অনেক কম। গোপন সূত্রে জানা যায়, এর কারণ হলো লঙ্ঘনের সময়কাল কম ছিল, কমিশনের প্রধান লক্ষ্য ছিল কোম্পানিগুলোকে নিয়ম মানতে বাধ্য করা এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সম্ভাব্য প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ এড়ানো। ইইউ নিয়ন্ত্রক সংস্থা জানিয়েছে, অ্যাপল অ্যাপ ডেভেলপারদের ওপর এমন কিছু শর্ত আরোপ করেছে, যার কারণে তারা অ্যাপ স্টোরের বাইরের সস্তা বিকল্পগুলোর দিকে ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। যদিও ব্রাউজার পরিবর্তন সংক্রান্ত সুবিধা চালু করায় অ্যাপল একটি আলাদা তদন্তে জরিমানা থেকে রক্ষা পেয়েছে। তবে সাইডলোডিং বা বিকল্প অ্যাপ স্টোর ব্যবহারের সুযোগে বাধা দেওয়ায় অ্যাপল এখনো ডিএমএ লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত। কোম্পানিটির নতুন 'কোর টেকনোলজি ফি'-কেও বিকল্প অ্যাপ ব্যবস্থাপনার পথে বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে। অন্যদিকে, মেটার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের 'পে-অর-কনসেন্ট' মডেল নভেম্বর ২০২৩ থেকে নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত সময়ে ডিএমএ লঙ্ঘন করেছে। এই মডেলে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহারের অনুমতি দিতে হতো অথবা বিজ্ঞাপনমুক্ত সেবা ব্যবহারের জন্য অর্থ পরিশোধ করতে হতো। মেটা জানিয়েছে, তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনা করছে এবং নভেম্বর ২০২৪-এ পরিবর্তিত মডেল ডিএমএর আওতায় পড়ে কিনা, তা নিয়ে তারা স্পষ্টতা চায়। ইউরোপীয় কমিশন জানিয়েছে, এই দুই কোম্পানিকে নিয়ম মানার জন্য দুই মাস সময় দেওয়া হয়েছে। অন্যথায়, তাদের দৈনিক জরিমানা দিতে হবে। বর্তমানে, গুগলের বিজ্ঞাপন প্রযুক্তি ব্যবসা এবং ইলন মাস্কের মালিকানাধীন এক্সের (সাবেক টুইটার) বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য আন্দ্রেয়াস স্কভাব কমিশনকে সতর্ক করে বলেছেন, এ ধরনের তদন্তে দেরি হলে ইউরোপীয় প্রতিযোগিতা নীতির গুরুত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তবে ইউরোপীয় কমিশনের প্রতিযোগিতাবিষয়ক প্রধান তেরেসা রিবেরা বলেছেন, 'আমরা স্বচ্ছ ও পূর্বনির্ধারিত নিয়মের ভিত্তিতে কঠোর কিন্তু ভারসাম্যপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছি। ইউরোপে ব্যবসা করতে হলে ইউরোপীয় নিয়ম মেনেই চলতে হবে।' ইউরোপীয় কমিশনের সূত্র বলছে, চলতি মাসের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালতের রায়ে গুগলকে অনলাইন বিজ্ঞাপন প্রযুক্তির দুটি বাজারে অবৈধভাবে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। ওই মামলার রায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রকদের জন্য গুগলের বিজ্ঞাপন ব্যবসা বিভক্ত করার পথ খুলে দিতে পারে। তথ্যসূত্র: রয়টার্স