ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৫: ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন শেখ হাসিনা। তার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যাংক খাতে ঋণের নামে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। এই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার এবং আত্মসাৎ করা হয়েছে, যা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ফেরত আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এর ফলে ব্যাংকগুলোতে তীব্র তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে, যা আমানতের সুদের হার বাড়াতে বাধ্য করেছে। এছাড়াও, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ঋণের সুদের হার বাড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ সরবরাহ কমে গেছে। তারল্য সংকটের কারণে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য যে বন্ড ও বিল বিক্রি করে, সেগুলোর সুদের হারও অনেক বেড়ে গেছে। ফলে সরকারকে এখন আগের চেয়ে বেশি সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে, যা ঋণের খরচ বাড়িয়েছে। সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতের অনিয়মের ফল এখন সরকারের ওপরও পড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট তীব্র হতে শুরু করে। ইসলামী ব্যাংকসহ এস আলম গ্রুপের অধীনে থাকা সাতটি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক এবং সরকারি জনতা ব্যাংকসহ আরও কিছু ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়লে ঋণের সুদের হার বাড়তে থাকে। এই সংকটের নেতিবাচক প্রভাব প্রথমে বেসরকারি খাতে পড়লেও, এখন তা সরকারি খাতেও দৃশ্যমান হচ্ছে। সরকার ব্যাংক খাত থেকে বিভিন্ন বন্ড ও বিলের মাধ্যমে যে ঋণ নেয়, সেগুলোর সুদের হার গত দুই বছরে ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য ৩ মাস, ৬ মাস ও ১ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিল এবং ২ বছর, ৫ বছর, ১০ বছর, ১৫ বছর ও ২০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ড ব্যবহার করে। এছাড়া, ইসলামী শরিয়াভিত্তিক বন্ডও রয়েছে। সরকার নিয়মিত নিলামের মাধ্যমে এসব বিল ও বন্ড ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে ঋণ সংগ্রহ করে। বর্তমানে ব্যাংকে তারল্য সংকট থাকায় অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এসব বিল ও বন্ড কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আগে ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদি বন্ডে বিনিয়োগ করতে চাইলেও এখন স্বল্পমেয়াদি বিল বন্ডে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। ফলে, সরকারের চাহিদা অনুযায়ী নিলামে অংশগ্রহণের পরিমাণ কমে যাওয়ায় সুদের হার বাড়ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুনে ৩ মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদের হার ছিল ৬.৮০ শতাংশ, যা ২০২৫ সালের ৬ এপ্রিল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১.২৪ শতাংশে। ৬ মাস মেয়াদি বিলের সুদের হার একই সময়ে ৭.০৭ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১১.৪৫ শতাংশ। এক বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদের হার ৭.৯০ শতাংশ থেকে বেড়ে ১১.৭৫ শতাংশে পৌঁছেছে। সরকার এই উচ্চ সুদে ৯ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। অন্যদিকে, ২ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদের হার ৮.০৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১২.১৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ৫ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদের হার ৮.৭১ শতাংশ থেকে বেড়ে ১১.৫০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ১০ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদের হার ১২.৫৯ শতাংশ থেকে কমে ১০.২৩ শতাংশে নেমে এলেও, বর্তমানে তা বেড়ে ১২.০৫ শতাংশ হয়েছে। ১৫ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদের হার ১২.৭০ শতাংশ থেকে কমে ১০.৪৯ শতাংশে নেমে আসার পর, এখন তা বেড়ে ১২.২৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদের হার ১২.৭৯ শতাংশ থেকে কমে ১১.১৮ শতাংশে নেমেছিল, যা বর্তমানে বেড়ে ১২.৫৪ শতাংশে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো সরকারের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দিতে পারছে না, যার ফলে সুদের হার বাড়ছে। ৬ মাস মেয়াদি বাংলাদেশ সরকার ইসলামী ইনভেস্টমেন্ট বন্ডের মুনাফার হার ৯ এপ্রিল বেড়ে সর্বনিম্ন ৯ থেকে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ৩ মাস মেয়াদি একই বন্ডের মুনাফার হার সর্বনিম্ন ৮ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ শতাংশে পৌঁছেছে। এই দিনে সরকার ১ হাজার ২২৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। বর্তমানে সরকার ব্যাংক থেকে কম ঋণ নিয়ে নন-ব্যাংক খাত থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই খাত থেকে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে, যে ঋণের সুদের হার আরও বেশি। উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়ায় সরকারের খরচ বাড়ছে এবং সুদ খাতে বাড়তি ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সরকার ব্যাংক থেকে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এই ঋণ দিয়ে আগের সরকারের সময়ে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। তবে, ছাপানো টাকায় ঋণের স্থিতি বেশি ছিল। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই স্থিতি কমে ৯৭ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই সময়ে সরকার ৫৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকার ছাপানো টাকার ঋণ পরিশোধ করেছে।