টেলিকম খাতেও হানা দিয়েছেন সালমান এফ রহমান। শেয়ারবাজারের মতো এই খাতকেও তিনি ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশনের ব্যবসায় প্রভাব খাটিয়ে প্রায় ৬২৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, আন্তর্জাতিক গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) ব্যবসায় নিজের প্রভাব বিস্তার করে ২৬টি প্রতিষ্ঠানকে কুক্ষিগত করেন সালমান। এরপর নিজের প্রভাবের মাধ্যমে এই গেটওয়েগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেন তিনি। এ ঘটনার পর আইজিডব্লিউতে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। অনেকেই বিষয়টি বুঝতে পারলেও সালমানের প্রভাবের কারণে মুখ খুলতে সাহস পাননি। টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য সালমান এফ রহমান নামে-বেনামে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। অভিযোগ রয়েছে, ২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনি অপারেটরদের বাধ্যতামূলকভাবে তার নিজের প্রতিষ্ঠানে টাকা পাঠাতে বাধ্য করেন। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক বিবেচনায় বিতর্কিত শামীম ওসমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু ও জাহাঙ্গীর কবির নানককেও আইজিডব্লিউ লাইসেন্স পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে সালমানের বিরুদ্ধে। এই লাইসেন্স পাইয়ে দিতে বড় ধরনের আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলেও শোনা যায়। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিতেই তাদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল বলে মনে করা হয়। চারটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও, সালমানের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সালমান এফ রহমান ১৮ জন সদস্যকে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধ্য করেন। এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিটিআরসি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) শরণাপন্ন হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. এমদাদ উল বারী জানান, গেটওয়েতে অর্থ আদায়ের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা ছিল। আইজিডব্লিউর সঙ্গে জড়িত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে টেলিকম খাত দুর্নীতি ও অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সালমান এফ রহমান এই খাতে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। যারা এই সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে চেয়েছে, তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। তৎকালীন টেলিযোগাযোগমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে মিলে সালমান এফ রহমান ২৩টি বেসরকারি অপারেটরের মধ্যে ১৮টিকে নিয়ে আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। এর মাধ্যমে তিনি আইজিডব্লিউ অপারেটরের ওপর নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর নিজের নামে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। আইজিডব্লিউগুলো একই লাইসেন্সের অধীনে থাকার কথা থাকলেও, সেগুলোকে দুটি স্তরে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে টিয়ার-১-এ ১৬টি এবং টিয়ার-২-এ ৭টি প্রতিষ্ঠানকে রাখা হয়। অভিযোগ রয়েছে, বিটিআরসি তাড়াহুড়ো করে টিয়ার-২-এর (আইওএস সুইচ পরিচালনাকারী) সাতটি আইজিডব্লিউর নাম চূড়ান্ত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো হলো: ইউনিক ইনফোওয়ে, ডিজিকন টেলিকমিউনিকেশন্স, রুটস কমিউনিকেশন্স, গ্লোবাল ভয়েস, মীর টেলিকম, বাংলা ট্র্যাক ও নভো টেলিকম। সূত্র জানায়, ১৮টি প্রতিষ্ঠান থেকে সালমানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কয়েক দফায় টাকা পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে বেক্সিমকো কম্পিউটার লিমিটেডে ২৪৯ বার, বাংলাট্রাকে ২৫ বার, গ্লোবাল ভয়েস টেলিকমের অ্যাকাউন্টে ৪২ বার এবং ডিজকোনের অ্যাকাউন্টে ২৫ বার টাকা পাঠানো হয়েছে। ইউনিক ইনফোওয়েতে পাঠানো হয়েছে ১ বার। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক সালমান এফ রহমান নিজেই। তিনি কৌশলে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা যায়, ২০১২ সালে ডিজিকন টেলিকমিউনিকেশন্স প্রধানমন্ত্রীর এক আত্মীয়ের সুপারিশে লাইসেন্স পায়। তবে বিটিআরসির রাজস্ব পরিশোধ না করায় ২০১৩ সালের জুলাই মাসে এই প্রতিষ্ঠানটিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। রুটস কমিউনিকেশন্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক প্রধানমন্ত্রীর একজন বিশেষ সহকারী। গ্লোবাল ভয়েসের মালিকানায় রয়েছেন এ কে এম শামসুদ্দোহা। এই কোম্পানিতে সালমান এফ রহমানের ছেলেও জড়িত রয়েছেন বলে জানা যায়। এদিকে, মোবাইল অপারেটরদের আর্থিক সুবিধা দেওয়ার জন্য ‘মার্কেট ডেভেলপমেন্ট এক্সপেন্স’ নামে একটি তহবিল তৈরি করা হলেও, সেটি তেমন কোনো কাজে আসেনি। অভিযোগ রয়েছে, সালমান এফ রহমানের নেতৃত্বেই টিয়ার-২-এর সাতটি অপারেটরের সিন্ডিকেট অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। তিনি অপারেটরদের থেকে ৬০ শতাংশ অর্থ নিয়ে, নেটওয়ার্ক উন্নয়নের কথা বলে প্রতি মাসে ১০ শতাংশ হারে কেটে নিতেন। ২০১৫ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত আইজিডব্লিউ অপারেটর থেকে বাজার উন্নয়ন ব্যয়ের নামে প্রায় ৬২৫ কোটি টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে। তবে এই অর্থ কোথায় এবং কীভাবে ব্যয় হয়েছে, তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। সব মিলিয়ে এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। আইজিডব্লিউ তাদের আয়ের ৪০ শতাংশ বিটিআরসি, ১৭.৫ শতাংশ আইসিএক্স এবং ২২.৫ শতাংশ এএনএসের কাছে জমা দেয়। টিয়ার-১ ও টিয়ার-২-এর রাজস্ব বণ্টনের হার ১:১.৯০। গত ১২ বছরে প্রতিটি আইওএস অপারেটরের আয় ৩৮০ কোটি ৬০ লাখ টাকার বেশি। যেখানে নন-আইওএস অপারেটরের আয় মাত্র ১৯৬ কোটি ৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ, একই লাইসেন্সধারী হয়েও একটি আইওএস অপারেটর, নন-আইওএস অপারেটরের চেয়ে ১৮০ কোটি ৫০ লাখ টাকা বেশি আয় করেছে। অন্যদিকে, গত ৯ বছরে অনেক অপারেটর এই সিন্ডিকেটের কারণে প্রায় নিঃস্ব হয়ে গেছে।